মোহাম্মদ আইয়ুব
একদা এক রাজ্যে ছিলেন এক রাজা। রাজার কর্মকাণ্ডে প্রজারা বেশ সন্তুষ্ট ছিল। রাজ্যের সব পেশাজীবীরা রাজার জনহিতৈষি কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহায়তা করতে লাগল। দিন দিন রাজ্যের উন্নতি সাধিত হচ্ছিল। রাজ্যময় খুশির বন্যা বয়ে যেতে লাগল। অন্য রাজ্যের রাজা-বাদশারাও রাজার এই প্রজাহিতকর কাজের প্রশংসা করতে শুরু করলেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের এক মহারাজ রাজার এই কল্যাণমূলক কাজের প্রশংসা করে একটি পত্র দিলেন, সাথে উপহার হিসেবে দুই শুঁড় বিশিষ্ট একটি হস্তিশাবক পাঠালেন।
মাহারাজের প্রশংসাপত্র ও উপহার পেয়ে রাজাতো মহাখুশি। দুই শুঁড় বিশিষ্ট হস্তিশাবকটি অতি যত্নে লালন পালন করতে লাগলেন এবং সময় পেলেই সেটির সাথে খেলা করতেন। রাজ্যের প্রজাকুলের ভালবাসা পেয়ে রাজা আরো জনহিতকর কাজে মনোনিবেশ করলেন।
হঠাৎ দেখা দিলো এক মহাবিপত্তি। একদিন রাজার মাথার একটি চুলের গোড়ায় ব্যথা শুরু হল। ব্যথার যন্ত্রণায় রাজা শয্যাশায়ী হলেন। রাজকর্মচারী, পেশাজীবী এবং প্রজাসাধারণের চেহারা চিন্তায় মলিন হয়ে গেল। রাজদরবার সহ রাজ্যের সব সেবামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
এমতাবস্থায় রাজ্যের উজির,
নাজির, কোতোয়াল, পাইক-পেয়াদারা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসল। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজ্যময় ঢোল পিটিয়ে দিল।
সব ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, ফকির-দরবেশ, ওঝা-বৈদ্য, জ্বিন হুজুর, বুদ্ধিজীবী এমনকি চৌধুরী বাড়িতে সদ্য জন্ম নেওয়া অলৌকিক শিশুটিকেও রাজদরবারে তলব করা হলো। তলব মতে নির্ধারিত সময়ে সবাই দরবারে হাজির হলো।
প্রধান উজির আমন্ত্রিত বিজ্ঞজনদের উদ্দেশ্যে রাজার রোগের বর্ণনা দিলেন। বর্ণনা শেষে রাজার রোগ নিরাময়ে কার কী দাওয়াই আছে, একে একে সকলের নিকট জানতে চাওয়া হলো।
প্রথমে এক কবিরাজ দাঁড়িয়ে বললেন- হুজুর, রাজার মাথা ব্যথা সারাতে হলে-থানকুনি পাতার রস পান করাতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা, দিনে দুই বেলা। আগামী অমাবস্যার রজনীর প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত সেবন করাতে হবে। থানকুনি পাতার গুণাগুনের শেষ নেই। রাজার মাথা ব্যথা উপশম হবেই।
সভাসদ-বিষয়টি বিস্ময়ের সাথে নোট করলেন।
দোলনায় করে আনা সদ্য ভূমিষ্ট চৌধুরী বাড়ির অলৌকিক শিশু দোলনা থেকে উঠে চেয়ারে বসে পা নাচাতে নাচাতে বলল-রাজার মাথা ব্যথার মুক্তি চাইলে, আদা-লেবুর রস দিয়ে রং চা পান করাতে হবে এবং কালি জিরার সাথে খাঁটি মধুর মিশ্রণ ৬ মাস সেবন করাতে হবে।
এই কথা বলে নিজে এক কাপ রং চা বানিয়ে চেয়ারে পা দোলাতে দোলাতে পান করল এবং সকলের চোখে ধূলা দিয়ে চোখের পলকে শিশুটি হাওয়া হয়ে গেল।
সভাসদ-বিষয়টি অতি বিস্ময়ের সাথে নোট করলেন।
ফকির কেরামত শাহ দাঁড়ালেন-রাজা জনহিতকর কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাঁর এহেন কাজের কারণে কিছু বদ লোকের মুখ (কুদৃষ্টি) পড়েছে। রাজার মাথা ব্যথা নিরাময় করতে হলে, জয়তুন তৈলপড়া মাথা থেকে পা পর্যন্ত মালিশ করতে হবে।
প্রধান উজির : ব্যথা হলো লক্ষ লক্ষ চুলের মধ্যে একটি চুলের গোড়ায়, তৈলপড়া সারা শরীর মালিশ করতে হবে কেন ?
ফকির কেরামত শাহ : রাজার মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। গালে দাঁড়ি-গোঁফ, বুকে-পিঠে, হাতে-পায়ে পশম,শরীরের আরো কিছু অংশেও পশম আছে। সুতরাং যেখানে পশম, সেখানেই মালিশ।
সভাসদ-বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নোট করলেন।
দরবেশ ন্যাড়া বাবা দাঁড়ালেন-রাজার মহৎ কাজে রাজ্যময় শান্তি বিরাজ করছে। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য রাজাকে সদা মাথা ঘামাতে হয়। হুজুরের মাথায় লক্ষ লক্ষ ঘন কালো চুল। এখন মাত্র একটির গোড়ায় ব্যথা শুরু হয়েছে। বাকি গুলির গোড়ায় ব্যথা শুরু হলে, প্রাণ ভোমরা বের হতে সময় লাগবে না। সুতরাং সময় থাকতে মাথার সমস্ত চুল ফেলে দিতে হবে।
প্রধান উজির : মাত্র একটি চুলের গোড়ায় ব্যথা, সমস্ত চুল ফেলে দিয়ে ন্যাড়া হতে হবে কেন ?
দরবেশ ন্যাড়া বাবা : এমনিতে প্রজাকুলের বোঝা মাথায়, তার উপরে এতো চুল থাকলে মাথা ব্যথা তো হবেই। দেখছেন না, আমার মাথায় চুল নেই। কোন ব্যথাও নেই। তৈলাক্ত ন্যাড়া মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আহারে, কি যে শান্তি !
সভাসদ-বিষয়টি নোট করলেন।
কালিন্দর ওঝা দাঁড়ালেন- আমার হাজিরায় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, রাজার সিনায় তিনটি বান পড়েছে। শীঘ্রই এই বান কাটাতে হবে। নইলে মাথার ব্যথা বুকে নেমে আসবে। শনি-মঙ্গলবারে রাজার পদধুলি আমার দরবারে ফেলতে হবে। আমি সিনার বান কেটে রাজাকে সুস্থ করে তুলবো। সুস্থ শরীরে রাজার জ্যোতির্ময় হাসি দেখে রাজ্যময় শান্তি ফিরে আসবে। প্রজাকুলের চেহারা থেকে যৌবনোচ্ছল দ্যুতি বিচ্ছুরিত হবে।
সভাসদ-বিষয়টি আনন্দের সাথে নোট করলেন।
জ্যোতিষী ফজুবৈদ্য দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, রাজার মাথায় মস্ত বড় ব্যারাম ঢুকেছে। তা একটি চুলের গোড়া দিয়ে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এখনই উপযুক্ত সময়, এই ব্যারাম সারানোর। মাঘ মাসের পূর্ণিমাতিথির রাতে রাজাকে পাতকূপে গোসল করাতে হবে। মাথা ব্যথা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রধান উজির: রাজ্যের পাশে বিশাল সমুদ্র থাকতে পাতকূপে কেন ?
জ্যোতিষী ফজুবৈদ্য : দেখুন, পূর্ণিমার রাতে পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য একই সরলরেখায় অবস্থান করে। সূর্য ও চন্দ্রের মিলিত আকর্ষণ বলের প্রবল টানে তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়। জোয়ারের স্থানে অত্যধিক জলস্ফীতি ঘটে এবং ভাটার স্থানে জলস্তর খুব বেশি মাত্রায় নেমে যায়। এই সময় সমুদ্রে গোসল করা নিরাপদ নয়। অমঙ্গল হতে পারে।
সভাসদ- বিষয়টি সানন্দে নোট করলেন।
জ্বিন হুজুর দাঁড়ালেন-রাজার অসুখে রাজ্যময় অশান্তি বিরাজ করছে। কালবিলম্ব না করেই রাজাকে সুস্থ করে, রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রজাদের মুখে আবার হাসি ফোটাতে হবে।
ইফরিত জ্বিন হস্তিশাবক রুপধারণ করে রাজার মাথার উপর ভর করেছে। এই জ্বিনের আছরের কারণে জাহাপনার মাথার একটি চুলের গোড়ায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। ইফরিত জ্বিন তাড়াবার উত্তম দিবস বৃহস্পতিবার। তাই আগামী বৃহস্পতিবারে ১৩টি কালো পাঁঠা ছদকা দিতে হবে। তবেই এই জ্বিন তার নিজ আবাসে ফিরে যাবে। রাজার মাথা ব্যথাও সেরে যাবে।
প্রধান উজির : বিভিন্ন রংয়ের পাঁঠা ছাগল থাকতে কালো পাঁঠা কেন?
জ্বিন হুজুর : জাহাপনার মাথার চুল, মুখের দাঁড়ি-গোঁফ, চোখের ভ্রু, বুক-পিঠ, হাত-পা সহ অন্য অংশের পশমও কালো। আর ইফরিত জ্বিন তার অবস্থান জানান দিচ্ছে মাথার একটি কালো চুলের মাধ্যমে। সুতরাং কালো পাঁঠার পশমের বিনিময়ে জাহাপনার মাথা ব্যথা উপশম হবে।
সভাসদ-বিষয়টি আগ্রহের সাথে নোট করলেন।
সস্ত্রীক আগত বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী জনাব মুছিবত খাঁ দাঁড়ালেন, আমাকে এই ভরা মজলিশে দু’কথা বলার সুযোগ দেওয়ায় রাজদরবারের সকল অমত্যবর্গ, উজির-নাজির, পাইক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্ত সহ অন্দরমহলের বাতি জ্বালানোর কাজে নিয়োজিতদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। এই রাজ্যের মধ্যমণি, প্রজাকুলের চোখের মণি, বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি, অন্ধের যষ্টি, রাজ্যের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, রাজমুকুট যার মাথায় শোভা পায়, আমার প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয় মহামান্য রাজা মহাশয় মাথার একটি চুলের গোড়ার অসহ্য যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করছেন। রাজ্যের যত পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী সকলেই দিশাহারা। জাহাপনাকে এমন কষ্ট থেকে মুক্ত করতে আমার সু-চিন্তিত মতামত হচ্ছে- রাজা মহাশয়ের মাথা কেটে ফেলে দেওয়া। এর আর কোন বিকল্প নাই।
সাথে সাথে মছিবত খাঁ’র স্ত্রী
বলা খাতুন মাথা নেড়ে স্বামীর কথায় সায় দিলেন।
প্রধান উজির : কিভাবে ?
বুদ্ধিজীবী মুছিবত খাঁ : দেখুন উজির সাহেব, হিসেব একদম সোজা। মাথাও নাই, ব্যথাও নাই। অতএব, আর কালবিলম্ব না করে রাজার মাথা বিচ্ছিন্ন করা হোক।
উচ্ছ্বসিত সভাসদ বিষয়টি নোট করলেন।
সব শেষে দাঁড়ালেন, রাজ্যের খ্যাতিমান ডাক্তার। আমি উজির সাহেবের মুখে রাজা বাহাদুরের রোগের বর্ণনা শুনেছি। কিন্তু শোনা কথার উপর পথ্য লিখে দেওয়া আমার শাস্ত্র পরিপন্থী। আমি জাহাপনার ব্যথার স্থান স্ব-চক্ষে দেখে দাওয়াই দিতে চাই।
ডাক্তার সমেত প্রধান উজির অন্দরমহলে রাজার শিয়রে এসে দণ্ডায়মান হলেন। ডাক্তার রাজার মাথার বর্ণিত চুলের গোড়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলেন, একটি “আঁড়ালি” চুলের গোড়ার চামড়াতে কামড়ে ধরে আছে। (“আঁড়ালি” হচ্ছে এক প্রকার রক্তচোষা পরজীবী কীট। যা গোরু-ছাগল, হাতি-ঘোড়ার পশমের আড়ালে বাস করে এবং রক্ত চোষণ করে বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে মানুষের শরীরেও দেখা যায়।) ডাক্তার সাহেব বললেন, রাজার মাথার চুলটির গোড়া থেকে এই আঁড়ালিটি ছুড়ে ফেলে দিলেই মাথা ব্যথা নিশ্চিত সেরে যাবে।
বিজ্ঞ সভাসদ ডাক্তারের কথা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেন। অনিচ্ছা সত্বেও বাস্তব প্রয়োগ দেখতে চাইলেন। ডাক্তার বাবু রাজার মাথা থেকে আঁড়ালিটি অপসারণ করলেন।
লেখক-
অফিসার ইনচার্জ
লালমাই থানা, কুমিল্লা
১৬ আগষ্ট ২০২০ খৃষ্টাব্দ।।
Leave a Reply